ভাবনা হোক নিরাপদ উন্নয়নের

কার্যকর জাতীয় সংসদ এবং সরকার ও দলীয় ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ

বাংলাদেশের সংবিধানে একটি বিতর্কিত ধারা রয়েছে যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী সংসদে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না, যদি তা তাদের দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের এমপিদের দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য করার ক্ষমতা দেয়।

বাংলাদেশের সব বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোরই নিজস্ব সমর্থক ঘাঁটি রয়েছে, যারা সাধারণত কোনো বিবেচনা ছাড়াই তাদের দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়। এই ভোটারদের প্রায়ই দলের “ভোট ব্যাংক” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর বাইরে ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দলনিরপেক্ষ ভোটার এবং এই দলনিরপেক্ষ ভোটাররাই একটি রাজনৈতিক দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নির্ধারক শক্তি হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই নির্দল-অনুষঙ্গিক ভোটারদের আকার খুব একটা ছোট নয়, যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে এই ভাসমান ভোটারদের চাওয়ার ওপর জোর দিতে হয় ক্ষমতা লাভের জন্য। এবং এটাই গণতন্ত্রে।

১৯৯০-এর দশকে স্বৈরাচারী শাসন থেকে গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের পরে রাজনৈতিক সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়, বিবিধ কারণে দুই প্রধান দলের কাছ থেকে সে প্রত্যাশা ম্লান হয়। স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি সহ একজন নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করার সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। দলীয় সংশ্লিষ্টতা ব্যতিত কোন ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের অন্তত এক শতাংশের স্বাক্ষর জমা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতার অভাব রয়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে এই বিধানটি ১৯৭২ সালের আরপিওতে (রিপ্রেজেনটেশণ অফ পাবলিক অর্ডার) (২০০৮ সালে সংশোধিত) তে যুক্ত করা হয়েছিল।

ফলস্বরূপ, একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তার মনোনয়ন জমা দেয়ার আগেই কয়েক হাজার ভোটারের সম্মতি নিশ্চিত করতে হয়, যেখানে এই কাজটা খুব একটা সহজ না। কয়েক হাজার স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে একজনও যদি অস্বীকার করেন যে তিনি স্বাক্ষর করেন নাই, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। এদেশের প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবটা বিবেচনা করলে, এটা সহজেই কল্পনীয় যে এধরণের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে স্বাক্ষর অস্বীকার করানো কঠিন কিছু না। যদিও অযাচিত মনোনয়ন দাখিল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই ধারাটি যুক্ত করা হয়েছিল, বাস্তবতা হল , এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য একজন ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে।

গণতন্ত্রের সৌন্দর্য দলনিরপেক্ষ ভোটারদের মন জয় করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের ইশতেহারে ও কৌশলগুলোকে জনগণের স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হয়। সংসদের কার্যকরীতা নিশ্চিত করার লক্ষে স্বতন্ত্র ভাবে যেন কিছু সদস্য নির্বাচিত হতে পারে (যারা ট্রেজারি বেঞ্চ বা বিরোধী পক্ষের নয়) এরও ব্যবস্থা থাকা উচিত । যেহেতু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের তাদের নিজস্ব বিবেচনার ভিত্তিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেয় না, এখানে সরকারি দল এবং বিরোধী দল উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সংসদীয় বোর্ডের সিদ্ধান্তে স্বৈরাচারীভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে এবং দলের আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় এর বাস্তবতা উপস্থিত। সাধারণ নির্বাচনে দল নিরপেক্ষ ভোটার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংসদের ভিতরে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণে নির্দলীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিও জরুরি, যারা দৃঢ় এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির সক্ষমতা রাখে। তাদের উপস্থিতি সরকারী ও বিরোধীদল উভয়কেই পক্ষপাতপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখবে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, একজন প্রার্থীকে তার জামানত ফেরত পেতে হলে অবশ্যই প্রদত্ত ভোটের অন্তত এক-অষ্টমাংশ ভোট নিশ্চিত করতে হয়। এখানে অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি ভোটারদের মধ্যে প্রার্থীর ন্যূনতম যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি মানদণ্ড হিসাবে কাজ করে। বর্তমান আরপিও অনুযায়ী পূর্বে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে তার এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর নিতে হয় না। এটি প্রস্তাব করা যেতে পারে যে একজন ব্যক্তি যিনি আগে একটি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাদের জামানত না হারিয়ে নির্বাচনী এলাকার অন্তত এক-অষ্টমাংশ ভোট পেয়েছেন তাকে একজন যোগ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যারা আগে কোনো সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি বা ভোটের প্রয়োজনীয় অংশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা ভোটারদের এক শতাংশের স্বাক্ষর সংগ্রহের পরিবর্তে ওই নির্বাচনী এলাকার মধ্যে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের (ইউনিয়ন সদস্য/চেয়ারম্যান, পৌর/সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর/মেয়র) অন্তত এক-অষ্টমাংশের স্বাক্ষর জমা দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি একইসাথে অযাচিত মনোনয়নের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ উভয়ই কিছুটা হলেও নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি এক শতাংশ ভোটারের বিধানও বহাল থাকতে পারে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের আইন প্রণেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে রক্ষা করার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিভিন্ন সংসদীয় গণতন্ত্রে এটি প্রায়শই দেখা গেছে যেখানে ফ্লোর ক্রসিং এর মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটনোর মত ঘটনা আছে। সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য এই বিধানটি এখনও প্রাসঙ্গিক।

সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলন এটা তুলে ধরেছে যে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বৈষম্যহীনতার চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই এই পঞ্চাশটি সংরক্ষিত আসন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত সাকুল্য ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এটি দলগুলির জন্য তাদের যোগ্য চিন্তাবিদদের সংসদে স্থান দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে যারা যোগ্য, অথচ নির্বাচনে জয়ী হয় নাই, অথবা সাধারণত নির্বাচনে জয়ী হতে পারে না অথবা নির্বাচনে অংশগ্রহণে যাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতা আছে। উপরন্তু, ছোট দলগুলো যারা দেশব্যাপী উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় ভোট অর্জন করেছে কিন্তু সংসদে কোনো আসন পায়নি তারা দেশব্যাপী তাদের প্রাপ্ত সাকুল্য ভোটের অনুপাতে সংসদে প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে পারে।

রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব এবং নির্বাহী কর্তৃত্ব পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে, একজন প্রার্থীকে তাদের প্রার্থীতা জমা দেওয়ার আগে তাদের রাজনৈতিক পদ থেকে পদত্যাগ করা দরকার। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের দলীয় পদে ফেরত আসা নিষিদ্ধ করার বিধান, (যেমন এক বছর বা ছয় মাসের জন্য)  রাখা যেতে পারে, যদি তারা তাদের পছন্দসই স্থানীয় সরকার পদে জয়ী হতে ব্যর্থ হয়। এই ধরনের বিধান তাদের নিজস্ব বলয়ের ভিতরে একটি স্বৈরাচারী মনোভাব তৈরি করতে বাধা দেবে।

একইভাবে, সরকারে মন্ত্রী বা অন্য কোনো নির্বাহী পদের জন্য মনোনীত একজন এমপিকে রাজনৈতিক দলের ভিতরে তাদের নির্বাহী পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। এই বিধানটি নিশ্চিত করবে যে মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ তাদের সরকারী দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব উভয় পোর্টফোলিও পরিচালনায় পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকবে। অর্থাৎ একই ব্যক্তি একইসাথে সরকার এবং দলের নির্বাহী কর্তৃত্বে থাকবে না। স্থানীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয় ক্ষেত্রেই, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ সংশ্লিষ্ট দলের প্রাথমিক সদস্যপদে থাকার বিধান রাখা যেতে পারে।

Share your love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *