মোহাম্মাদ জাহিদূর রহমান
জাতীয় সংসদে ২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট আলোচনার শেষ দিনে অর্থমন্ত্রী বলেন “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি যে অর্থনীতির গতিকে মন্থর করতে পারে তা অস্বীকার করার উপায় নাই।“
মূল্যস্ফীতি যা ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ক্রয় ক্ষমতাকে দুর্বল করে তা দু’ভাবে হতে পারে। একটি উৎপাদনের উপকরনের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে, যেটাকে বলা হয় কষ্ট পুশ ইনফ্লেসন। অন্যটি হল বাজারে মুদ্রার যোগান বৃদ্ধিজনিত কারণে পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে, যেটিকে বলা হয় ডিমান্ড পুল ইনফ্লেসন।
যখন অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং উচ্চমজুরি পাওয়া যায়, তখন সাধারণ মানুষের আয়স্তর বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ভোক্তার তরফ থেকে সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এই ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায় যে কারণে পণ্যের মালিক ও সেবার পরিবেশনাকারীর জন্য সুযোগ তৈরি হয় মূল্যবৃদ্ধির। এই অবস্থা যখন প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে তৈরি হয়, একে বলে ডিমান্ড পুল ইনফ্লেসন।
বাংলাদেশে চলমান মূল্যস্ফিতি বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে ঘটে নাই। কভিড পরবর্তি বৈশ্বিক অবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ বেকার, আবার যারা কর্মে নিযুক্ত আছেন তাদের অনেকেরই বেতন ভাতা আগের চেয়ে কম।
সাধারণভাবে একটা দেশে বেকারত্তের হার কম থাকা ভাল। বেকারত্ব না থাকা বা কম থাকা মানে অর্থনীতিতে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ বেশি থাকা। ২০১৯ এ বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৩৮% যেখানে ২০২০ এ কভিড চলাকালিন সময়ে তা বেড়ে হয় ৫.২১%। কভিড পরবর্তীতে ২০২২ সালে বেকারত্ব নেমে দাড়ায় ৪.৭০%। ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি কমে আসে। সুতরাং ইহা প্রতীয়মান যে বেকারত্ব হ্রাসজনিত কারণে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে ডিমান্ড পুল ইনফ্লেসন যেটা হওয়ার কথা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা প্রযোজ্য না।
মে ২০২৪ এ মূল্যস্ফিতির হার ছিল ৯.৮৯ যেখানে জানুয়ারি ২০২০ এ তা ছিল ৫.৫৭%। মূল্যস্ফীতি হারের বৃদ্ধির এই কারণ সম্পূর্ণভাবেই উৎপাদনের উপকরনের মূল্য বৃদ্ধির কারণে। টাকার অবমূল্যায়নে একই পরিমাণ উপকরণ আমদানিতে আগের চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। টাকার সাথে ডলারের বিনিময় হার ২০২১ এ যেখানে ছিল ৮৪.৮৬, ২০২২ ও ২০২৩ তা দাড়ায় যথাক্রমে ১০৩.০২ এবং১০৯.৭৫। অবশেষে এ বছর মুদ্রার বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ চালু করার মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় ১১৭.০০ তে।
একটি দেশের মুদ্রার মূল্যমান এবং বিনিময় হার মূল্যস্ফিতির হারকে প্রভাবিত করে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্তরকে বৃদ্ধি করে। ফলে এটি প্রতীয়মান যে স্থানীয় মুদ্রার দুর্বলতা মূল্যস্ফিতিকে উস্কে দেয়।
মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রচলিত উদ্যোগ হল ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করা। পলিসি রেটের বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহনের খরচ বৃদ্ধি করা হয়। এই অবস্থায় ভোক্তা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ গ্রহনের মাধ্যমে বিনিয়োগের চিন্তা করতে দুবার ভাবতে হয়। এই প্রক্রিয়া আর্থিক ব্যয়কে সীমিত করে। চাহিদা কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফিতিকেও কমিয়ে আনে।
মুদ্রানীতির এই উপকরণটি বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। কিন্তু বাংলাদেশের মূল্যস্ফিতি ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনের উপকরনের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে সৃষ্ট। আগস্ট ২০২১ এ বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮.১ বিলিয়ন ডলার, যেটি মে ২০২৪ এ নেমে আসে ২৪.২ বিলিয়ন ডলারে।
এটা প্রতীয়মান যে বাংলাদেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফিতি চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে না। ইহা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসজনিত কারণে এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে। ফলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এখানে সেভাবে কাজ করবে না, যেভাবে মনে করা হচ্ছে।
পলিসি রেটের বৃদ্ধি এবং ঋণের সুদের হার নির্ধারণে ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড়ের সাথে নির্ধারিত মুনাফার সংযোজন কোন ভাবেই অর্থনীতিকে বাড়তে দিবে না। এটির মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে আয় সীমিত হবে এবং পণ্যের চাহিদাকে হ্রাস করবে। ফলাফল হিসাবে উৎপাদকেরা উৎপাদন সীমিত করবে। এভাবে অর্থনীতি একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পতিত হবে। প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে। এমন কি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিও হতে পারে।
যেহেতু বাংলাদেশে চলমান মূল্যস্ফিতি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না, এখানে আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু পদক্ষেপ জরুরি যেখানে মেয়াদউত্তীর্ণ রফতানি আয় প্রত্যাবসন এবং মুদ্রাপাচার নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর রফতানি তথ্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি আয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১২.০৮ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য ধরা পড়ে, যেখানে ইপিবির রফতানি তথ্য ৬৩.০৫ বিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি আয় ৫০.৯৭ বিলিয়ন ডলার। সময়ের পার্থক্য এবং রফতানির টার্মস এন্ড কন্ডিশনের মতোনৈক্যে কিছু পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এত বড় পার্থক্যের কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করা উচিত যে এখানে কোন অপ্রত্যাবসিত রফতানি আয় রয়েছে কি না।
ট্রান্সপারেন্সি ইনটারনেস্নাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর তথ্যমতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৬,৪০০ কোটি টাকা বা ৩.১ বিলিয়ন ডলার পাচার হয় হুন্ডি, ওভার ইনভয়েচ, আন্ডার ইনভয়েচের মাধ্যমে।
দুর্নীতি একটি দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি বিনিয়োগ হ্রাস করার মাধ্যমে শিল্প উৎপাদনকে ব্যাহত করে। নিঃসন্দেহে দুর্নীতি অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় সমস্যা। কিন্তু এর পরও এটি অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা না। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং জিডিপিতে অবদান রাখে। অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অর্থ পাচার। টাকা বৈধ বা অবৈধ যে ভাবেই অর্জিত হোক না কেন, একবার পাচার হলে তা আর ফেরত আসে না এবং আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কোনভাবে অবদান রাখার সুযোগ আর থাকে না। এর মাধ্যমে যে ক্ষতি হয় তা অপুরনীয়। তাই অর্থ পাচার রোধ করাটা অতীব জরুরি।